Business

Games

দেশের চলচ্চিত্র জগতে বিষয়বস্তু বলতে বেঁচে আছে শুধুই জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম।

   দেশের চলচ্চিত্র জগতে প্রতিভা বলতে বোঝায় নেকুপুষুসুন্টুনিমুন্টুনিদের। আর বিষয়বস্তু বলতে বেঁচে আছে শুধুই জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম। ঠিক সেই সময়ে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার মঞ্চে পুরস্কার হাতে দাঁড়ানো দুটি মুখ। পায়েল কাপাডিয়া, অনুসূয়া সেনগুপ্ত।



দেশ মানে যখন শুধুই উন্নয়নের বাণী (যা অনুভব করতে হয়, চোখে দেখা যায় না) বিদ্বেষ আর ঘৃণা ভাষণ। তখন গলিঘুপচির বাস্তব অন্ধকার, প্রতিদিন বিক্রি হয়ে যাওয়া মেয়ের রাগ ক্ষোভ যন্ত্রণা কান্না রক্ত ঘাম অবলীলায় তাদের হাত ধরে পর্দায় উঠে আসে। সিস্টেম যখন সৃষ্টিশীলতার মধ্যে উদ্দেশ্য খোঁজে তখন তারা প্রতিবাদকে ভয় পায়। সত্য সামনে এলে বীরত্বের ফানুস ফুসমন্তর হয়ে যায়। যেমন এক সময়ের স্রোতস্বিনী নদীও স্রোত হারালে ডোবা হয়ে যায়। পরে ডাস্টবিন। কিন্তু প্রকৃত প্রতিভা অনুৎপাদক সিস্টেমের আসল রূপ অনুভব করেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। যারা জানান দেয় এখনও দেহে আছে প্রাণ। 'আজাদি' আন্দোলনের আগে পায়েল কাপাডিয়ারা প্রতিবাদী হয়েছিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বরং বলা যায় এই পর্যায়ের একচ্ছত্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রথম ছাত্র আন্দোলন। যা পরে জেএইউ-সহ অনান্য প্রতিষ্ঠানেও দেখা গিয়েছিল।
২০১৪ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন তৎকালীন ৫৬ ইঞ্চি বর্তমানের ভগবানের দূত। ক্ষমতার স্বাভাবিক ধর্ম বিভিন্ন পদে নিজের তাঁবেদার বসানো। মোসাহেব বসিয়ে ক্ষমতাসীনরা মগজে ভাবনায় সৃষ্টিশীলতায় বুলডোজার চালিয়ে আপন মত প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু স্বাধীন শিক্ষানবিশরা শাসকের সেই বাঁধা গতের চৌকাঠ অতিক্রম করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বারবার। ২০১৫ সালে পুণে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার(এফটিটিআই) গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে অভিনেতা গজেন্দ্র চৌহানকে বসানোর প্রতিবাদে সরব হয় তৎকালীন সেখানকার পড়ুয়ারা। তাদের দাবি ছিল বি আর চোপড়ার 'মহাভারত' সিরিয়ালে যুধিষ্ঠিরের ভূমিকায় অভিনয় করে বিখ্যাত হওয়া গজেন্দ্রর ওই পদে বসার যোগ্যতা নেই। কিন্তু পড়ুয়ারা ভুলে গিয়েছিল পর্দার যুধিষ্ঠিরের পকেটে আছে 'আনুগত্যের' শংসাপত্র। তাই প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় পুলিশি দমনপীড়ন। যা ক্ষমতার অহংকারের স্বাভাবিক প্রকাশ। সেই আন্দোলনে সেদিনের অভিযুক্ত পায়েলই আজ পুরস্কৃত কানের মঞ্চে। আর সবচেয়ে মজার ঘটনা পায়েলের বিরুদ্ধে মামলা করা এফটিটিআই বাধ্য হয়েছে প্রকাশ্যে তাকে অভিনন্দিত করতে। পাশপাশি এও স্মরণে রাখতে হবে, চলতি বছরের আগামী ২৬ জুন আদালতে গজেন্দ্র চৌহানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা সেই মামলার শুনানি।
শুধুমাত্র গল্প বা সিনেমায় নয়। সমাজজীবনে কখনও কখনও ক্লাইম্যাক্স তৈরি হয়। কানের মঞ্চ ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের কান ধরে সেই ক্লাইম্যাক্সে এনে ফেলছে। দুই তরুণী আজ নিজেদের যোগ্যতায় আন্তর্জাতিক এই মঞ্চে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ স্বপ্ন দেখা তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে তারা।
পায়েল প্রতিবাদী হয়েছে কিন্তু নিজের ক্ষেত্র ছেড়ে বের হয়নি। সেই সময়ে গজেন্দ্রর বিরুদ্ধে অযোগ্যতার অভিযোগ তোলার যোগ্যতা যে তার ছিল আজ সে তার নিজের ক্ষেত্র দিয়েই প্রমাণ করেছে। যেটা জেএনইউয়ের আজাদি আন্দোলনের ক্ষেত্রে বলতে পারা যাবে না। সেই আন্দোলনের মুখ এখন রাজনৈতিক মসনদ দখলের লড়াইয়ে দল বদলু।
পায়েল কাপাডিয়া কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অভিযুক্ত হয়েই থামেনি। বরং যে শিক্ষার দাবিতে তার লড়াই ছিল। সে শিক্ষাকে হাতিয়ার করে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। এমনকি পুরস্কার পাওয়া সিনামার বিষয়বস্তুও প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে।
তাদের এ লড়াই শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই। আজ দেশে যখন কোটি কোটি টাকা ঢেলে দূর্বল স্ক্রিপ্টের বিশেষ প্রচার সর্বস্ব সিনেমার রমরমা। শিল্পের চেয়ে আনুগত্য প্রকাশের প্রতিযোগিতা, সেখানে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র নিজের প্রতিভাকে পুঁজি করে আত্মবিশ্বাসের জোরে এই মঞ্চে আরোহনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না তা বলাই যায়। তবে তা যে অসম্ভব নয় তাও প্রমাণিত হল। দেশের নামীদামী প্রযোজনা সংস্থাগুলির কাছেও এই দৃষ্টান্ত একটা চ্যালেঞ্জ।
পায়েল পরিচালিত এবং অনুসূয়ার অভিনীত পুরস্কার প্রাপ্ত দুটি সিনেমারই প্রযোজক বিদেশি সংস্থা। দেশের লক্ষ কোটি টাকার বড় বড় প্রযোজনা সংস্থা গুলির কেউ কী বুক চাপড়ে বলতে পারবে বিশ্ব চলচ্চিত্রে ভারতীয় সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অন্তত একটা সিনেমা তারা বানিয়েছে? বরং প্রতিপদে তারা স্বাধীন ভাবনা সৃজনশীলতাকে ব্যবসায়িক স্বার্থের পায়ে বলি দিতে উদ্যোত হয়েছে। ক্ষমতাসীনের তোষামোদি করতে করতে পায়ের তলার মাটি যে ঝুরঝুরে হয়ে যাচ্ছে সেটা যদি আজও বুঝতে না পারে তবে তাদের সাধের প্রতিষ্ঠান পতিত হতে সময় লাগবে না। ছকে বাঁধা গন্ডিতে লাভক্ষতির হিসাব মিলতে পারে কিন্তু আঁধার শেষে ভোরের সূর্যোদয় দেখতে হ্যারিকেন নিয়ে যাওয়া বোকামির নামান্তর। আলো ফোটার আগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তাই প্রতিষ্ঠানের। সৃজনশীলদের জন্য খোলা আছে সারা বিশ্বের দুয়ার।