Business

Games

» » » » ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে হেনস্তা করাটাও নারী নির্জাতন

 সমাজ বদলের আগে নিজেকে বদলান। মনে দ্বেষ পুষে রেখে দেশ বদল হয় না

রাত তখন ১২টার মত বাজে। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাত দখল চলছে। অজস্র সাধারণ মানুষের ভিড়ে রয়েছেন বেশ কিছু রুপোলি পর্দার মানুষ। তাঁরা কেউ কোনও অসাধারণত্ব দাবি করেননি। রয়েছে একাধিক সংবাদমাধ্যম। এমন সময়ে শ্যামবাজারে পৌঁছন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। না, তাঁকে কেউ আমন্ত্রণ জানায়নি। তাঁর মনে হয়েছে আসবেন, এসেছিলেন। সম্প্রতি শঙ্খ বাজানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেষ্ট ট্রোলিংয়ের শিকার হয়েছেন। সেই সব থেকে বের হয়েই এসেছিলেন, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, একজন নারী হিসেবে। শ্যামবাজারেই আসতে চেয়েছিলেন। এই ধরণের জমায়েতে পুলিশের পক্ষে আলাদা করে কাউকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব না মাথায় রেখেই এসেছিলেন। কোনও নিরাপত্তা চাননিও। ওখানে উপস্থিত আমরা কয়েকজন নিজেরাই ওঁকে একটু ধাক্কাধাক্কি থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। আবার বলছি, তাঁর অনুরোধে নয়। নিজেরাই। এর পরের ঘটনাক্রম কিন্তু 'সাধারণ' নয়। শুনুন:

একটা জায়গায় মোমবাতি জ্বালানোর পরে একটু এগিয়ে ঋতুপর্ণা আরেকটি জায়গায় মোমবাতি জ্বালাতে গেলেন। হঠাৎ করেই এক দল মানুষ অধৈর্য হয়ে 'গো-ব্যাক' স্লোগান দিতে শুরু করলেন। শুরুতে ইতস্তত করেও স্লোগানের তীব্রতা বাড়তে দেখে সেখান থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন ঋতুপর্ণা। ব্যাপারটা যদি এই পর্যন্ত হয়ে থেমে যেত, তাহলে কিচ্ছু বলার ছিল না। এই লেখার প্রয়োজনই হত না। কিন্তু, তার পরে কী ঘটল! গো-ব্যাক স্লোগান দিতে দিতে উত্তেজিত জনতা শ্রেণি যারা নাকি 'সুশীল নাগরিক সমাজ'-এর অংশ, তারা ঋতুপর্ণাকে শারীরিকভাবে নিগ্রহের চেষ্টা করতে থাকেন এবং মারমুখী হয়ে ওঠেন। ঘটনার আকস্মিকতায় ওইখানে উপস্থিত আমরা সবাই বেশ হকচকিয়ে যাই। উত্তেজিত জনতা স্লোগান দেওয়ার পরেও প্রথম যেখানে মোমবাতি জ্বালিয়েছিলেন সেইখানে এসে মাটিতে বসেন ঋতুদি। নিপাট উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর শহরের মানুষ গুলোর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো।
আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করে ঋতুদিকে ওই জায়গা থেকে ঠিকভাবে বার করে নিয়ে যেতে পারি। প্রত্যেকের নাম এখানে মেনশন করছি। আমার অনুজ সাংবাদিক রাকেশ Rex Naskar III, অভিনেতা ভ্রাতৃপ্রতিম Rishav Basu, Rishav-এর টিমের এক বোন, অভিনেত্রী Ratasree Dutta, শিল্প নির্দেশক Amit Chatterjee এবং ঋতুদির ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী #Rahul Das. ঋতুদি বসে থাকাকালীন হঠাৎ আমাকে আর রাকেশকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় বেশ কয়েকজন। আমি প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ি ওঁর ঘাড়ের কাছে গিয়ে। আমি যখন উঠতে যাই, মারমুখী জনতার মধ্যে থেকে দু-তিনজন কনুই দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ কয়েকবার জোরে আঘাত করে আমার ডান দিকের চোয়ালে, যেটা এখনও রীতিমতো ফুলে আছে। রাতাশ্রী চোট পায়। স্থানীয় একজনের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক সুশ্রুষা করতে হয়। সে এখনও ট্রমায়। রাকেশের পা মাড়িয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়, ফলশ্রুতি তার যথেষ্ট শক্ত জুতোর একটা অংশ ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। কয়েকজন ইচ্ছাকৃতভাবে জলের বোতল দিয়ে বারবার সজোরে আঘাত করতে থাকেন আমার মাথার পেছনে। একজন রীতিমত পিছন থেকে টিপে ধরেন গলাও। রাহুল, ঋষভ, রাকেশ আর আমার পিঠে কত যে কিল, ঘুসি পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। উদ্দেশ্য ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে আঘাত করা! এরপরে কোনও রকমে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে গিয়ে বসানো হল গাড়িতে। এবার সেই জনতার একাংশ চড়াও হল গাড়ি ভাঙচুর করার উদ্দেশ্য নিয়ে। গাড়ির কাচে অনবরত আঘাত চলতে থাকে। কয়েকজন মহিলা এসে নিজেদের ব্যাগ এবং বিভিন্ন জিনিস দিয়ে গাড়ির কাচে আঘাত করতে থাকেন। গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েও ঋতুপর্ণা তাদের বোঝাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন যে তিনি সবার সঙ্গে একসাথে বিচারের দাবি জানাতে এসেছেন। কে শোনে কার কথা! স্লোগান এবং অসভ্যতা চলতে থাকল।
এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে অসামাজিকতার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে এই সমাবেশ গুলোতে। কাল সেটারই পরিস্ফুরণ হল, আমার মনে হয়। প্রতিবাদের মোটিভ না বুঝেই প্রতিবাদে সামিল হওয়ার থেকে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করতে পথে নেমে কখনও নৈরাজ্যকে হাতিয়ার করা চলে না। যারা পথে নামলেন নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে, তারা একজন নারীকে হেনস্থা করবার আগে দু'বার ভাববেন না? এতে কলঙ্কিত হয় সমাবেশ, বিপ্লব। সমাজ বদলের আগে নিজেকে বদলান। মনে দ্বেষ পুষে রেখে দেশ বদল হয় না।
অনেকেই বলছেন, ঋতুপর্ণা আজকে এখানে এলেন কেন! আমি বলব, একদম ঠিক করেছেন। শ্যামবাজারে যেখানে সেই নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, সেখানেই এক রাতে তিনি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, মা হিসেবে এসেছেন নারীর মর্যাদার লড়াইয়ে সামিল হতে। হায় রে, আমার কলকাতার নাগরিক সমাজ তাঁকে সেই মর্যাদাটুকু দিতে পারল না।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর শাঁখ বাজানোর ঘটনা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, মানুষের ফেক মনে হয়েছে এবং সেই জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেষ্ট ট্রোল করা হয়েছে। কিন্তু তিনি সমাজের কোনও ক্ষতি করেননি তো! বরং ধর্নার নামে একাধিক রাজনৈতিক নেতা যারা বিভিন্ন মঞ্চে বসে থাকছেন তারা দস্তুর মত সমাজের ক্ষতি করে চলেছেন। সঠিক শত্রু চিনতে শিখুন। যে সব মানুষের উস্কানিতে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন কিছু 'কোট আনকোট' সাধারণ মানুষ, তারা মনে রাখবেন একটা শ্রেণি কিন্তু দিনের শেষে নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছাতে ব্যস্ত।
ধর্ষকরা মিছিলে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তাদের সঙ্গে সেলফিও তুলে ফেলছেন, ঠিক আছে। কিন্তু ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর সঙ্গে যে আচরণ করা হল সেটা অন্যায়, অসভ্যতা এবং অসাংবিধানিক। কারণ তিনি অপরাধী নন যে একজন নারী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে তিনি বিচারের দাবিতে পথে নামতে পারবেন না। তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর একাধিক নেতার মত তিনি জেল খাটা আসামি নন, তিনি দিনের শেষে একজন শিল্পী।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর গাড়ি ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর ফিরে আসার সময় মহিলাদের একটি দল রীতিমত আমাকে ঘিরে ধরে উত্তেজিত ভাবে প্রশ্ন করতে থাকেন কেন আমি ঋতুপর্ণাকে বাঁচাচ্ছিলাম! বিশ্বাস করুন, আশ্চর্য হয়ে গেছি আমি! আমি জানিনা তাদেরকে এই সাহস কে দিয়েছে একজনকে শারীরিক নিগ্রহ করতে চেষ্টা করার এবং নজিরবিহীন এই অসভ্যতা করার। তবে আবার বলছি, রাজনৈতিক মদত ছাড়া এই হুলিগানিজম্ সম্ভব নয়।
যাঁরা শুরু থেকে এই আন্দোলনকে বিপথগামী হওয়া থেকে বুক দিয়ে আগলেছেন, তাঁদের প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। Sudipta Chakraborty, Sharmistha Goswami Chatterjee, Debjani Laha Ghosh এবং আরও অনেকের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, কাদের নিয়ে পথে নামছি! বাঙালির জনজাগরণ দেখতে দেখতে আবেগে ভেসে কোনও ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? কোনও মদতপুষ্ট হাতে স্টিয়ারিং ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না তো! কোনও ভুল কথা বলে থাকলে ক্ষমা করবেন।
Rituparna Sengupta দি, ক্ষমা চাইছি তোমার কাছেও।
নিজেদের ভাগে রইল, ছিঃ। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ যদি না হয় তবে বলতে বাধ্য হব যে আপনারা নারীর মর্যাদার লড়াই করছেন না, তিলোত্তমাকে নিয়ে রাজনীতি করছেন।
©️
অতনু রায়

«
Next
This is the most recent post.
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply

Note: only a member of this blog may post a comment.